শক্রবার ১৯ সেপ্টেম্বার ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

বঙ্গাব্দ
রাজনীতি

"ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৮টি হলে'র ছাত্রদলের কমিটি নিয়ে বিতর্ক/বিক্ষোভ, পদ পেয়েছেন ছাত্রলীগের অনেকে"

নিউজ ডেস্কঃ ০৯ আগষ্ট ২০২৫ ১০:৩৯ এ.এম

ছাত্রদল ছাত্রদল

বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) হলগুলোতে আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা নিয়ে নানা সমালোচনা ও বিতর্ক দেখা দিয়েছে। কমিটিতে নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের অনেক নেতা–কর্মী রয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে ছাত্রদলের কমিটি ঘোষণার প্রতিবাদে মধ্যরাতে বিক্ষোভ করেছেন শিক্ষার্থীরা।
 
বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৮টি আহ্বায়ক কমিটি দিয়েছে ছাত্রদল। এসব কমিটিতে ৫৯৩ জন শিক্ষার্থীকে স্থান দেওয়া হয়েছে। এসব কমিটি নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদলের অনেক নেতাও অভিযোগ করেছেন। তাঁদের ভাষ্যমতে, কমিটিতে ‘ত্যাগী ও পরীক্ষিত’ নেতাদের বাদ দিয়ে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের পছন্দের কর্মীদের গুরুত্বপূর্ণ পদ দেওয়া হয়েছে।
এসব অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে ছাত্রদলের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা। কমিটিতে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের সিনিয়র সহসভাপতি মো. মাসুম বিল্লাহ, সিনিয়র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মো. নাছির উদ্দিন ও সাংগঠনিক সম্পাদক মো. নূর আলম ভূঁইয়াকে রাখা হয়েছে। তিন কার্যদিবসের মধ্যে কমিটিকে তদন্ত প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।

হল কমিটিতে ‘ছাত্রলীগের’ নেতা–কর্মী
ছাত্রদলের হল কমিটিগুলোতে নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের প্রায় ৬০ জন সাবেক নেতা–কর্মী পদ পেয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এর মধ্যে শামসুন নাহার হলে ছাত্রলীগের সাবেক উপ-গণযোগাযোগ সম্পাদক নিতু রানী সাহা একই হলে ছাত্রদলের কমিটির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক পদ পেয়েছেন। জীববিজ্ঞান অনুষদে ছাত্রলীগের সাবেক সহসভাপতি রাকিবুল হাসান ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ হল ছাত্রদলের সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক পদ পেয়েছেন।
স্যার এ এফ রহমান হল ছাত্রলীগের সাবেক সহসম্পাদক সাখাওয়াত হোসেন একই হলে ছাত্রদলের কমিটিতে যুগ্ম আহ্বায়কের পদ পেয়েছেন। সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ ছাত্রলীগের সাবেক সদস্য রায়হান আহমেদ সিব্বির মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হল ছাত্রদলের যুগ্ম আহ্বায়ক হয়েছেন। ২০২৪ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ছাত্রলীগের ঝিনাইদহ–৪ আসনে সমন্বয়ক দলের সদস্য শিবলী রহমান (পাভেল) হাজী মুহম্মদ মুহসীন হল ছাত্রদলের কমিটিতে যুগ্ম আহ্বায়ক হয়েছেন। ছাত্রলীগের নাটোর–২ আসনের সমন্বয়ক দলের সদস্য মো. আজিজুল হাকিমকে জিয়াউর রহমান হল ছাত্রদলের কমিটিতে যুগ্ম আহ্বায়ক করা হয়েছে।
এ ছাড়া বিগত সময়ে নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের কমিটিতে না থাকলেও নিয়মিত ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন—এমন অনেকেই হল কমিটিতে স্থান পেয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক নাহিদুজ্জামান শিপন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা আমাদের জায়গা থেকে সর্বোচ্চ যাচাই–বাছাই করেছি। কিন্তু অনেকে তাদের ছাত্রলীগ পরিচয় গোপন করেছে। এ বিষয়ে আমরা একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছি।’
কমিটি থেকে ছয়জনকে অব্যাহতি
গতকাল সকালে নতুন হল কমিটিগুলো ঘোষণার পর রাতে ছয়জনকে বহিষ্কার করেছে ছাত্রদল। তাঁরা হলেন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ হল কমিটির আহ্বায়ক মোসাদ্দেক আল হক ও সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক রাকিবুল হাসান, শামসুন নাহার হল কমিটির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক নিতু রানী সাহা, জিয়াউর রহমান হল কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক রাজু শেখ এবং হাজী মুহম্মদ মুহসীন হল কমিটির সদস্য আহমেদ জাবির মাহাম ও এন এস সায়মন।
এক বিজ্ঞপ্তিতে ছাত্রদল বলেছে, অব্যাহতি দেওয়া ছয়জনের বিরুদ্ধে তথ্য গোপনের অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে। এ জন্য তাঁদের সাংগঠনিক পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।
পছন্দের কর্মীদের গুরুত্বপূর্ণ পদ দেওয়ার অভিযোগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত একাধিক নেতা অভিযোগ করে বলেছেন, নতুন কমিটিতে ত্যাগী ও পরীক্ষিত নেতাদের বাদ দিয়ে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের পছন্দের কর্মীদের গুরুত্বপূর্ণ পদ দেওয়া হয়েছে। ২০২১ সাল থেকে ছাত্রদলের সক্রিয় কর্মী আবু তালিব বলেন, ‘শেখ মুজিব হলের ৫৪ সদস্যের নতুন কমিটিতে আমার নাম নেই। অথচ ২০২২ সালে ক্যাম্পাসে আসা অনেক জুনিয়র নেতাও পদ পেয়েছেন।’
স্যার এ এফ রহমান হলের পদবঞ্চিত নেতা মুহাম্মদ মাহাদী হাসান ফেসবুকে ক্ষোভ প্রকাশ করে লিখেছেন, ‘২০২২ সাল থেকে জাতীয়তাবাদী আদর্শ বুকে লালন করে রাষ্ট্রযন্ত্রের বুট-বুলেটের সামনে বুক চিতিয়ে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছি। অথচ আজ আমার ত্যাগ ও বিশ্বস্ততার প্রতিদান দিলেন ঢাবি ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক নাহিদুজ্জামান শিপন স্বজনপ্রীতি করে তাঁর আপন ছোট ভাইকে আমার জায়গায় বসিয়ে।’
এ বিষয়ে নাহিদুজ্জামান শিপন প্রথম আলোকে বলেন, কমিটিতে পদ পাওয়ার বিষয়ে একধরনের প্রতিযোগিতা থাকে। প্রতিযোগিতায় যাঁরা এগিয়ে থাকেন, তাঁরা ভালো পদ পান। যাঁরা পদ পাননি, তাঁরা সাময়িক হতাশার মধ্যে রয়েছেন।
কমিটি ঘোষণায় বিক্ষোভ
গত বছরের ১৭ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলো ‘ছাত্রলীগমুক্ত’ করার পর শিক্ষার্থীরা প্রতিটি হলের প্রাধ্যক্ষদের থেকে ‘আবাসিক হলে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ থাকবে’—এমন বিজ্ঞপ্তিতে স্বাক্ষর নেন। এরপরও ছাত্রদলের কমিটি ঘোষণা করায় ক্ষোভ জানিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী।
গতকাল বিকেলে উপাচার্যের বাসভবনের সামনে ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে হলে ছাত্ররাজনীতি পুনর্বাসন ও জুলাই বিপ্লবের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতার প্রতিবাদে’ বিক্ষোভ সমাবেশ করেন একদল শিক্ষার্থী। এ সময় তাঁরা ‘হলে হলে রাজনীতি/চলবে না চলবে না’, ‘গুপ্ত রাজনীতি/চলবে না, চলবে না’, ‘সুপ্ত রাজনীতি/চলবে না, চলবে না’ স্লোগান দেন।
এ ছাড়া মধ্যরাতে রোকেয়া হলের ভেতরে বিক্ষোভ করেন নারী শিক্ষার্থীরা। একপর্যায়ে তাঁরা ফটকের তালা ভেঙে বেরিয়ে এসে বিক্ষোভ করেছেন। তাঁরা রোকেয়া হলকে প্রকাশ্য ও গুপ্ত—সব ধরনের ছাত্ররাজনীতি থেকে সম্পূর্ণভাবে মুক্ত ঘোষণা করাসহ চারটি দাবি জানিয়ে হল প্রাধ্যক্ষকে স্মারকলিপি দিয়েছেন।
এদিকে ছাত্রদলের হল কমিটি নিয়ে ক্ষোভ জানিয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক মুখপাত্র উমামা ফাতেমা ফেসবুকে লিখেছেন, ‘গত বছর ১৬ জুলাই আবু সাঈদ শহীদ হওয়ার মাধ্যমে ছাত্ররা ক্যাম্পাস ছাত্রলীগমুক্ত করার সাহস পায়। কিন্তু বছর না ঘুরতেই গুপ্ত রাজনীতি ও প্রকাশ্য কমিটির চর্চা শুরু হয়েছে, যা স্পষ্টত জুলাই অভ্যুত্থানের সাথে বেইমানি। আজকে রাতের মধ্যে কমিটি স্থগিত না হলে শিক্ষার্থীরা কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।’
গতকাল বিকেলে মধুর ক্যানটিনে এক জরুরি সংবাদ সম্মেলনে গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদের আহ্বায়ক আবদুল কাদের বলেন, ‘জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের অন্যতম দাবি ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করা। কিন্তু ছাত্রশিবির সর্বপ্রথম গুপ্তভাবে হলে ছাত্ররাজনীতির সূচনা করে। পরবর্তী সময়ে ছাত্র ইউনিয়নও তাদের কমিটি ঘোষণা করে। আজ ছাত্রদলের কমিটি ঘোষণার মাধ্যমে আমরা সেই পূর্বের ধারার ছাত্ররাজনীতিতেই ফিরে গেলাম। এ অবস্থায় শিক্ষার্থীরা শঙ্কিত—হলগুলোতে আবার গণরুম–গেস্টরুমের সংস্কৃতি ফেরত আসবে।’

হলে শিবিরের গোপন কমিটি থাকার অভিযোগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোয় ইসলামী ছাত্রশিবিরের গোপন কমিটি রয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদ ও ছাত্রদলের কয়েকজন নেতা। গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সদস্যসচিব মহির আলম ফেসবুকে লেখেন, ‘ছাত্রদল হল কমিটি দিয়েছে। এটা সরাসরি ১৭ জুলাইয়ের সঙ্গে কনফ্লিক্ট (সংঘাত) করে। ছাত্রদলকে আপনারা যেভাবে প্রশ্নের সম্মুখীন করতেছেন, একইভাবে শিবিরকেও করা উচিত। শিবিরের কমিটি বা ছোট টিম (দল) যা–ই বলি, এটা হলগুলোতে অলরেডি এক্সিস্ট করে।’
গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদের আরেক নেতা আশিকুর রহমান ফেসবুকে লেখেন, ‘আজ ছাত্রদল যে হল কমিটি দিয়েছে, এর দায় একমাত্র শিবিরের। শিবির হলগুলোতে গুপ্তভাবে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করতেছে এবং মেয়ে হলে ছাত্রী সংস্থা কাজ করে। এখন বাকিরা কী করবে? বাকিরা রাজনীতি করবে না?’
সূর্য সেন হলে ছাত্রদলের নতুন কমিটির সদস্যসচিব আবিদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘গণতন্ত্রে রাজনৈতিক স্বচ্ছতা অপরিহার্য। কারণ, উদ্দেশ্য গোপন রাখা রাজনৈতিক প্রতারণার শামিল। শিবির দীর্ঘদিন ধরে হলে গোপনে রাজনৈতিক কার্যক্রম চালিয়ে শিক্ষার্থীদের আস্থা নষ্ট করেছে, যা গণতান্ত্রিক চর্চার পরিপন্থী। শুধু তা–ই নয়, এ ধরনের গোপন কার্যক্রম সরাসরি ’৭১ ও ’২৪–এর গণতান্ত্রিক দেশ বিনির্মাণের ক্ষেত্রেও প্রতিবন্ধক।’


এই সম্পর্কিত আরও খবর

আরও পড়ুন